ছোটগল্পঃ পেনশন

সাহিত্য

লেখকঃ সাইফুল আলম

-সালাম দিয়েছি জনাব!
-ওয়ালাইকুমুস সালাম!
-বসতে পারি?

অডিট অফিসার আব্দুল কুদ্দুস নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বৃদ্ধ পেনশনারকে বসতে দিলেন। এজিবি অফিসে প্রায় সব কাজই পেনশন বিষয়ক; এখানে এত দয়ার্দ্র হলে চলেনা!

-বাবাজি আমি বড়াইগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোঃছানাউল্লাহ প্রামানিক। শিক্ষিকতা জীবনে দুইবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসাবে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত!

অডিট অফিসার আব্দুল কুদ্দুসের চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি।

-আপনার পেনশন কেস নম্বর কত?

শিক্ষক ছানাউল্লাহ প্রামানিক তার পুরোনো ডায়েরি খুলে পেনশন কেস নম্বরটা দিলেন।

আব্দুল কুদ্দুস কেস নম্বর হাতে নিয়ে কম্পিউটারে কতক্ষন কি টিপাটিপি করলেন।

-মুরুব্বি, আপনার ফাইল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এখনো আসে নাই।

ছানাউল্লাহ প্রামানিকের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। তার এক বছরের পি আর এল প্রায় শেষ হয়ে আসছে।

আজ ছয়মাস যাবৎ প্রতি মাসে তিনি নাটোরের বড়াইগ্রাম থেকে ঢাকার মিরপুর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে আসছেন।

প্রথম প্রথম তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাড়িতে উঠতেন-এখন আর লজ্জায় উঠেন না। মানুষকে অহেতুক বিড়ম্বনায় ফেলার কোন মানে হয়না।

তিনি অধিদপ্তরের পাশেই এক মসজিদের খাদেমের সাথে খাতির করে রাতের বেলায় মসজিদে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহর ঘরে এক অসহায় প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের থাকার ব্যবস্থা! ছানাউল্লাহকে অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়েই মসজিদে রাত্রি যাপন করতে হয়। মসজিদ নামাজ পড়ার জন্য-ঘুমানোর জন্য নয়।

কখনো কখনো অধিদপ্তরের কাজ একটু আগে ভাগেই শেষ হয়ে যায়,দেহটা তখন একটু বিশ্রাম চায়। কিন্তু আল্লাহর ঘরে বান্দার ঘুমানোর অনুমতি নাই!

কমিটির কেউ জানতে পারলে খাদেমের চাকরি ‘নট’। তিনি ওই সময়টা মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের বেঞ্চিতে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেন।

মিরপুর সাত নম্বর সেকশনে এক টাকায় ছিন্নমূল ও ভবঘুরেদের জন্য একটা সরকারি রাত্রিনিবাস আছে। ওখানে ভদ্রলোকদের থাকার উপায় নেই; তার উপর তিনি জাতীয় পদক প্রাপ্ত শিক্ষক!

শিক্ষক ছানাউল্লাহ তার পকেট থেকে পুরোনো বাটন ফোনটা বের করলেন। অধিদপ্তরের ডেসপাস ক্লার্ক ওসমানকে ফোন করা দরকার।

-হ্যালো ওসমান ভাই! আমি জাতীয় পদক প্রাপ্ত শিক্ষক ছানাউল্লাহ বলছি!
-জি স্যার বলেন।
-এজিবি অফিস বলছে তারা আমার পেনশনের কেস পায় নাই!

-স্যার!আপনিতো জাতীয় পদকপ্রাপ্ত, আপনাকে কি করে যে বলি!
-ওসমান ভাই-আপনি অসংকোচে বলেন।
-স্যার, আপনি একটু নেছার স্যারের সাথে দেখা করেন!

-তার সাথে আমার একাধিক বার সাক্ষাত হয়েছে; তিনি আমাকে চিনেন!
-স্যার গো, এই সাক্ষাত সেই সাক্ষাত না!
আপনি তার সাথে একান্তে সাক্ষাত করুন; মিষ্টি খাওয়ান!

এজি অফিস থেকে বের হয়ে ছানাউল্লাহ প্রামানিক বনফুল মিষ্টান্ন থেকে দুই কেজি ক্ষীর চমচম কিনলেন, অনেক দাম!

নয়শত বিশ টাকা। পকেটে যে টাকা আছে টাকা শহরে বড়জোর আর দিন তিনেক থাকতে পারবেন।

তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। সুগার ফল করে হাইপো না হয়ে যায়!

তার দু’টি ছেলেমেয়ে এখনো কর্মক্ষম হল না। ছেলেটা অনার্স শেষ করল আর মেয়েটা অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে। বিয়েটা ঠিক সময়ে হলেও বিলম্বে সন্তানের মুখ দেখেছেন ছানাউল্লাহ। গ্রামে তার চাষ যোগ্য জমি তেমন নেই।

তিনি ভেবে রেখেছেন পেনশনের টাকায় মেয়েটার বিয়ে দেবেন, ছেলেটাকে বড়াইগ্রাম বাজারে একটা ফার্মেসী করে দেবেন। কিন্তু এই পেনশনের ফাইল ছাড়াতে গত ছয়মাসে তার বিশহাজার টাকার মত খরচ হয়ে গেছে, ফাইল এখনো অধিদপ্তর থেকেই মুভ করাতে পারলেন না।

এভাবে আরো ছয়মাস নাটোর ঢাকা আপডাউন করতে থাকলে নির্ঘাৎ ঋনে পড়বেন।

ডিজি অফিস প্রায় ফাঁকা, নেছার সাহেব তার অফিস কক্ষেই
আছেন। তার কক্ষের সামনে টুলে বসা দারোয়ান।

-চাচা কি চাই?
-স্যারের সাথে দেখা করব!বল আমি জাতীয় পদক প্রাপ্ত শিক্ষক ছানাউল্লাহ, নাটোরের বড়াইগ্রাম থেকে এসেছি!

-খাঁড়ান!

কিছুক্ষন পর ছানাউল্লাহর ডাক পড়ে।

-বসুন জনাব ছানাউল্লাহ!

-স্যার আমার পেনশনের কেসটা ছয়মাসেও এজিতে যায়নি!

-দাঁড়ান দেখছি!

নেছার সাহেব বেল টিপে ডিলিং অফিসারকে ডাকেন। তাকে শিক্ষক ছানাউল্লাহর পেনশনের ফাইলটি দিয়ে যেতে বলা হল।

-জনাব ছানাউল্লাহ চা দিতে বলি?

-না স্যার, এই দুপুর বেলা চা খাব না। আমি দীর্ঘক্ষন খালি পেটে আছি। এই যৎসামান্য মিষ্টি আপনার বাসার জন্য এনেছিলাম স্যার। যদি কিছু মনে না করেন; গ্রহন করে আমায় কৃতার্থ করবেন।

নেছার সাহেব মৃদু হাসলেন। তিনি গভীর মনোযোগে ছানাউল্লাহর পেনশন ফাইল দেখছেন।

-আপনার ফাইলে তো বিরাট ঘাপলা!
-কি সেই ‘বিরাট ঘাপলা’ স্যার?

-আপনি আমার ডিলিং অফিসারের সাথে কথা বলুন।

-স্যার, আপনার ডিলিং অফিসার গত ছয়মাস ধরে আমাকে ঘুরাচ্ছেন। কি নাকি ‘বিরাট ঘাপলা’ আমার ফাইলে!

আমি জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলেন না, শুধু এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে পাঠান এন্ড আই অ্যাম আনডান স্যার!
প্লিজ হেল্প মি, প্লিজ!

আমার আর্থিক অবস্থা খুবই সঙ্গীন, বেকার ছেলে, বিবাহ যোগ্যা কন্যা ও অসুস্থ স্ত্রী নিয়ে খুবই পেরেশানিতে আছি। নিজে ডায়াবেটিক পেশেন্ট, ক্রনিক লিভার ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ-প্লিজ দয়া করুন স্যার!

তেইশ বছর বয়সে শিক্ষকতায় ঢুকে ছত্রিশ বছর আপনাদের অধীনে চাকরি করলাম। এখনো আপনাদের আপন হতে পারলাম না, ফাইল এখনো এজিতেই মুভ করল না!

এজিতে যে কতদিন ঘুরতে হবে কে জানে? স্যার আমি কি পেনশন খেয়ে মরতে পারব?

জীবনভর ছাত্রদের গনিত শিক্ষা দিয়েছি; আজ নিজের জীবনের সরল অংকটাই মিলাতে পারছি না।

ছানাউল্লাহ প্রবল ভাবে ঘামছেন। তিনি খানিকটা উত্তেজিত। তার সারা শরীর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখের মনি ঘোলা হয়ে আসছে, হাত পা কাঁপছে হিস্টিরিয়া রোগীর মত। নেছার সাহেব ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন।
-খলিল! খলিল! এক গ্লাশ পানি নিয়ে আয় কুইক!

খলিল পানি নিয়ে এসে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। নেছার স্যার মিষ্টির প্যাকেট খুলে ক্ষীর চমচম ছানাউল্লাহ চাচার মুখে গুঁজে গুঁজে দিছেন!

-মিঃ ছানাউল্লাহ, আপনার ডায়াবেটিস। আপনি সব সময় কিছু চকলেট পকেটে রাখবেন। মনে রাখবেন ডায়াবেটিসে যত না রোগী মারা যায়, তার চেয়ে অধিক রোগী হাইপো গ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ সুগার নীল হয়ে মারা পড়ে।

নেছার সাহেব তার কক্ষের ডিভানে শিক্ষক ছানাউল্লাহকে শুইয়ে দিয়ে ‘হাই কুল’ মুডে এসি ছেড়ে দিলেন।

কি কেলেঙ্কারি! খোদা না করুন-আজ যদি ডিজি অফিসে ছানাউল্লাহ প্রামানিকের কিছু হয়ে যেত! ডিজি স্যার তাকে ছাড়তেন না, অন দ্য স্পট সাসপেন্ড!

প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ফেসবুকে ভাইরাল নিউজ হত-‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তার ঘুষের বলি হলেন ছানাউল্লাহ’!

অনেক দিন পর নেছার সাহেব প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়েছেন। তার বিপক্ষের লোকের অভাব নেই ডিজি অফিসে, তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

তিনি মিষ্টি স্বরে ডাকছেন।

-জনাব ছানাউল্লাহ, জনাব ছানাউল্লাহ! খলিল আপনাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দেবে। আপনি কি খানিকটা সুস্থ বোধ করছেন?

শিক্ষক ছানাউল্লাহ ক্ষীণ স্বরে শুধু বললেন-
-স্যার, আমার পেনশন ফাইলের ‘বিরাট ঘাপলাটা’র প্রতিকার কি?

-ডোন্ট অরি। আগামীকাল স্পেশাল মেসেঞ্জার আপনার পেনশন ফাইল এজিতে নিয়ে যাবে!

ছানাউল্লাহর চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে!

তিনি জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট দু’টি চাটছেন।
বিড়বিড় করে বলছেন-
জাযাকাল্লাহু খাইরান! জাযাকাল্লাহু খাইরান!

কমেন্ট করুন